

Apr 23, 2025
| নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের শতাধিক প্রকল্পে ১৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যার অধিকাংশই জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক। ফলে পরিবেশদূষণ বাড়বে। প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবসম্মত না হওয়ায় এ বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এমন একমুখী বিনিয়োগনীতির ফলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছে এনজিও ফোরাম অন এডিবি।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলা মোটরে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির বিনিয়োগ ঝুঁকি উন্মোচন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এডিবির ৫৮তম বার্ষিক সাধারণ সভার আগে যৌথভাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এনজিও ফোরাম ও কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)।
সম্মেলনে বক্তারা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ মডেলের কড়া সমালোচনা করেন। তারা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এডিবির প্রতি আহ্বান জানান।
এনজিও ফোরাম অন এডিবির নির্বাহী পরিচালক রায়ান হাসান এডিবির জীবাশ্ম জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের বৈষম্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এডিবি বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর ৮২ দশমিক ৯ শতাংশ অর্থায়ন জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রকল্পে, ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে হয়েছে। বায়ুবিদ্যুতে এখন পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ নেই। জীবাশ্ম-জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পে প্রতি মেগাওয়াটে বিনিয়োগ ২ দশমিক শূন্য ৪ মিলিয়ন ডলার এবং সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার। এটা বেশ উদ্বেগজনক।
তিনি আরও বলেন, ‘এডিবির জ্বালানি নীতিতে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার প্রয়োজন। সক্রিয়ভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করতে হবে। ন্যায়সংগত ও সমতার ভিত্তিতে জ্বালানি রূপান্তরে নেতৃত্ব দিতে হবে। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে অর্থায়নকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, যাতে কার্বন-নির্ভরতা রোধ করা যায়।’
এনজিও ফোরামের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির বিনিয়োগকৃত প্রকল্প ১০৬টি। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, তেল-গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে এডিবির বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে এডিবির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় না নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ফলে এডিবির ৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৬৭টি জ্বালানি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এশিয়ার বহুজাতিক আর্থিক সংস্থাটির পরিকল্পনা, দক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাটির একাধিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও গ্যাস সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষণ বলছে, এডিবির ১১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা ৬৫ শতাংশ প্রকল্পে কোনো ধরনের সুরক্ষা শ্রেণীকরণই নেই, এটা স্পষ্টতই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। উচ্চঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশগত প্রকল্পে বরাদ্দ ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আর বাস্তুচ্যুতি ও স্থানীয়দের সুরক্ষায় বরাদ্দ মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ (৬০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার)।
এনজিও ফোরাম অন এডিবির জীবাশ্ম জ্বালানিবিষয়ক প্রচারাভিযানকারী শারমিন বৃষ্টি বলেন, ‘এ পরিসংখ্যান এডিবির টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এডিবির অর্থায়ন বিশ্লেষণ করে ক্লিনের প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, ‘এডিবি ভেড়ামারা থেকে খুলনা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটারের গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে গ্যাস নেই জেনেও তারা এ কাজটি করেছে। কল্পিত গ্যাসের ওপর নির্ভর করে আবার খুলনায় ২২৫ ও ৮০০ মেগাওয়াটের দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে। অথচ এসব প্রকল্প গ্যাসের অভাবে বছরের পর বছর বসে আছে, যা জনগণের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংক হিসেবে এডিবি এ কাজটি করতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু সংকটের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে আছে অথচ এডিবি এখনো জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করে চলেছে, যা আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে আমাদের বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছে। এডিবিকে অবশ্যই তার জ্বালানি নীতি পরিবর্তন করে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের দিকে যেতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে এনজিও ফোরাম অন এডিবি এবং ক্লিন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে তিনটি প্রধান দাবি উপস্থাপন করেছে। এগুলো হলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে সব অর্থায়ন বন্ধ এবং ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরে সমর্থন, প্রকৃত সুরক্ষা কৌশলের বাস্তবায়ন ও এফপিআইসি (ফ্রি, প্রায়োর ও ইনফর্মড কনসেন্ট) নিশ্চিত করা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি রাখা এবং কার্বন মার্কেট, গ্রিনওয়াশিং ও করপোরেট স্বার্থের নামে ছদ্ম জলবায়ু সমাধান নীতি প্রত্যাখ্যান করা।
সংবাদ লিঙ্ক: এডিবির বিনিয়োগে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ